‘গডফাদারের সৌদি–স্টাইল’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

সৌদি আরবের যুবরাজকে সারারাত আটক রাখা হলো রাজপ্রাসাদে। দিনের আলো ফোটার পর মক্কার প্রাসাদ থেকে বের হলেন তিনি। কিন্তু সব সময় তার পাশে থাকা দেহরক্ষীদের কাউকে খুঁজে পেলেন না। অগত্যা তার অপেক্ষায় থাকা গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। আটকাবস্থা থেকে মুক্তি পেলেন। কিন্তু অল্প সময় পরই তিনি আবিষ্কার করলেন, এ মুক্তির সঙ্গে আটকাবস্থার কোনো পার্থক্য নেই।

এ যুবরাজ হচ্ছেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। মোহাম্মদ বিন সালমানের আগে তিনি ছিলেন সৌদি আরবের যুবরাজ। যাহোক, আটক দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গাড়িতে উঠে একের পর এক খুদে বার্তা পাঠাতে শুরু করলেন তিনি। এর অধিকাংশই পাঠিয়েছিলেন তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত উপদেষ্টার কাছে, যিনি এর কয়েক সপ্তাহ আগে রাজপ্রাসাদ ছেড়েছিলেন। তাকে খুদে বার্তায় মোহাম্মদ বিন নায়েফ লেখেন, ‘খুব সাবধান! ফিরবেন না!’ খবর দ্য গার্ডিয়ানের।

মোহাম্মদ বিন নায়েফ মক্কা ছেড়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জেদ্দায় পৌঁছান। মূলত সেখানেই থাকতেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়েও দেখলেন নতুন পরিস্থিতি। দেখলেন, নতুন নিরাপত্তারক্ষীরা তার প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছেন। ফলে তার বুঝতে বাকি রইল না, তাকে গৃহবন্দী করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফ আবার তার সেই উপদেষ্টার কাছে খুদে বার্তা পাঠালেন। লিখলেন, ‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই ফিরে আসা উচিত হবে না।’

জেদ্দায় ফেরার আগের রাতে, অর্থাৎ ২০১৭ সালের ২০ জুন বেশ কিছু ঘটনা ঘটে মক্কার রাজপ্রাসাদে। ওই রাতে সৌদি বাদশার ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। রাজপরিবারের ভেতরের একটি সূত্র ক্ষমতার এ পালাবদলকে ‘গডফাদারের সৌদি-স্টাইল’ বলে বর্ণনা করেছেন। বিন নায়েফ সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি।

ওই বছরের শুরুর দিকে সিআইএর তৎকালীন পরিচালক ও পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কৃতিত্বের জন্য তাকে পুরস্কৃত করেছিলেন। সন্ত্রাসবিরোধী তার উদ্যোগে সে সময় অনেক মার্কিন নাগরিকের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

প্রাসাদ–অভ্যুত্থানের দুই বছর আগে যুবরাজের আসনে নায়েফকে বসিয়েছিলেন তার চাচা। বাদশা সালমান দায়িত্ব গ্রহণ করার পর মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ (ক্রাউন প্রিন্স) করা হয়। অর্থাৎ এর মাধ্যমে সৌদি সিংহাসনের প্রথম উত্তরাধিকার হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে এ পদে বসানোর পর থেকে রাজদরবারের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। কারণ, সেই সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন তারই চাচাতো ভাই বাদশা সালমানের ছেলে বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। বিশ্বে এখন তিনি ‘এমবিএস’ নামে বেশি পরিচিত। এমবিএস তখন ছিলেন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স।

নায়েফকে যুবরাজের পদ থেকে সরানোর আগে ২০১৭ সালের ৫ জুন আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে। ওই দিন সৌদি আরবসহ তার মিত্ররা কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করে। এতে মোহাম্মদ বিন নায়েফ ও এমবিএসের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে। প্রতিবেশী কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। কাতারভিত্তিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম আল-জাজিরার খবর ও স্থানীয় সন্ত্রাসবাদকে উসকে দেওয়ার অভিযোগ এনে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

মোহাম্মদ বিন নায়েফের সঙ্গেও কাতারের শাসকদের বৈরিতা ছিল। কিন্তু তিনি অবরোধ আরোপ নয়, কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিলেন। ফলে গোপনে কাতারের শাসক তামিম বিন হামাদ আল-থানির সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছিলেন তিনি। এ বিষয়ে নায়েফ তার সেই বিশ্বস্ত উপদেষ্টাকেও একটি খুদে বার্তা পাঠান। এতে লেখেন, ‘তামিম আজ ফোন করেছিলেন। আমি কল ধরিনি। আমি তার কাছে এমন একটি ফোন পাঠাতে চাই, যেটা কিনা নজরদারির বাইরে থাকবে।’

২০ জুন ২০১৭। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে মক্কার রাজপ্রাসাদে ডেকে আনা হয়। সূত্র বলছে, নায়েফ সেখানে এলে তার নিরাপত্তারক্ষীদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়। এদিনের কোনো তথ্য যাতে বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য সবার মুঠোফোন জব্দ করা হয়। এমনকি ওই রাজপ্রাসাদের কর্মীদের মুঠোফোনও সেই সময় জব্দ করা হয়। আর এ কাজ করেন এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। ঠিক এই সময় রাজপরিবারের এক সদস্য সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফটক থেকেই তাকে বিদায় করা হয়।

এরপর নায়েফকে এমবিএসের ঘনিষ্ঠ তুর্কি আল-শেখের কক্ষে নেওয়া হয়। তুর্কি আল–শেখ পরে সৌদি আরবের জেনারেল এন্টারটেইনমেন্ট অথরিটির প্রধান হয়েছিলেন। সেই কক্ষে নায়েফকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। তাকে যুবরাজের পদ ছাড়তে চাপ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাকে এমবিএসের আনুগত্য স্বীকার করতে বলা হয়। প্রথমে অবশ্য নায়েফ পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু পরে নায়েফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

রাজপ্রাসাদের একটি সূত্র গার্ডিয়ানকে বলেছে, পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর নায়েফকে বলা হয়, তিনি পদত্যাগ না করলে তার পরিবারের নারীদেরকে ধর্ষণ করা হবে। নায়েফের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস ছিল।

বলা হয়েছিল, তিনি যদি পদত্যাগ না করেন, তবে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ফলে তিনি এ ভেবে ভয় পেয়ে যান, হাসপাতালে তার শরীরে বিষ প্রয়োগ করা হতে পারে। তিনি এতটাই ভয়ে পেয়েছিলেন, ওই আটকাবস্থায় তিনি সেখানে পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান।

রাজপ্রাসাদে আটক অবস্থায় যুবরাজ নায়েফ শুধু রাজপরিবারের ‘অ্যালিজান্স কাউন্সিলের’ দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ কাউন্সিল পরবর্তী সময়ে কে বাদশা হবেন, সেটি ঠিক করে থাকে। কিন্তু নায়েফ শুনে অবাক হন, রাজপরিবারের ওই দুই সদস্য ইতিমধ্যে এমবিএসের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছেন।

রাত শেষ হলো, দিনের আলো ফুটল এবং সব শেষ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ক্লান্ত নায়েফ আত্মসমর্পণ করলেন। এ সময় পাশের কক্ষেই টেলিভিশন ক্যামেরা আর সশস্ত্র দেহরক্ষীদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন এমবিএসখ্যাত মোহাম্মদ বিন সালমান। সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন নায়েফ। ক্যামেরার সামনে এমবিএসের আনুগত্য স্বীকার করলেন তিনি। এ সময় রীতি অনুসারে নায়েফের হাতে ও হাঁটুতে চুমু খেলেন এমবিএস। পরে এই ভিডিও সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচার করা হয়।

নায়েফ আর যুবরাজ নেই। তিনি আর বাদশা হতে পারবেন না। ওই ঘটনার পর সরকারি ভবন থেকে তার ছবি, পোস্টার সরিয়ে ফেলা হয়। যুবরাজের পদে অধিষ্ঠিত হন মোহাম্মদ বিন সালমান। যিনি কিনা বাদশা হওয়ার দৌড়ে এখন সবার চেয়ে এগিয়ে এবং সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে গেলেন তিনি।

একটি বিষয় লক্ষ করা যেতে পারে, সৌদি বাদশা সালমান রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু দিনকে দিন শাসক হয়ে উঠছেন এমবিএস। সৌদি আরবের নিরাপত্তা, তেল, অর্থনীতি—সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ গেছে তার হাতে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ট নায়েফ, যিনি কিনা বাদশা হওয়ার দৌড়ে সবার সামনে ছিলেন, তিনি হয়ে গেলেন কয়েদি। এখানেই শেষ নয়, নায়েফের সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছিল।

নায়েফকে যুবরাজের পদ থেকে সরানো বা ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তনের সবকিছু হয়েছিল পর্দার আড়ালে। তবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ধরে পরে এসব তথ্য প্রকাশ হতে থাকে। এসব সূত্রের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাদ আলজাবরি। তিনি ছিলেন নায়েফের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। এ উপদেষ্টাকেই খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন নায়েফ। বলা হয়ে থাকে, যুবরাজ নায়েফের আমলে রাজপরিবারের বাইরে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সাদ আলজাবরি।

উত্তর আমেরিকায় একটি মামলাকে কেন্দ্র করে সাদ আলজাবরি ও নায়েফের আদান-প্রদান করা খুদে বার্তাগুলো প্রথম আলোর মুখ দেখে। ওই সময় সৌদি আরব তাকে গ্রেপ্তারের অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু ইন্টারপোল তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। আলজাবরির হয়ে যারা আইনি লড়াই করছিলেন, তাদের কাছ থেকে খুদে বার্তাগুলো পেয়েছে গার্ডিয়ান।

২০১৭ সালের শেষ দিকে নায়েফের গৃহবন্দিত্ব খানিকটা শিথিল করা হয়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মোটামুটি মুক্তিই পান তিনি। তবে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। তাকে মরুভূমিতে পাখি শিকার করতে দেখা গেছে। ২০১৯ সালের শেষ দিকে সমর্থকদের সঙ্গেও তাকে দেখা গেছে। কিন্তু ২০২০ সালে আবারও তাকে আটক করা হয়। ছয় মাস আটকে রাখা হয়। এ সময় তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এতে তার পা ও গোড়ালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাঁটাচলা কষ্টসাধ্য হয়েছে, তার ওজন কমে গেছে।

যুবরাজের পদ থেকে সরানোর পর নায়েফের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ব্যাংকে তার যে অর্থ রয়েছে, তা ২০১৭ সালে একবার ফেরত আনার চেষ্টা করেছিল সৌদি আরব। তবে তা এখনো পায়নি। ২০২১ সালে আরেকবার অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করা হয়। এ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

নায়েফ এখনো বন্দী। ট্রাম্প ও পরে জো বাইডেন প্রশাসন তাকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এতে একটুও টলেননি মোহাম্মদ বিন সালমান।

শেয়ার করুন