নয় মাস আগে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজা ঘোষণা করে রায় হয়েছে। আলোচিত এই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা ইতিমধ্যে ৪৮টি আপিল দায়ের করেছে। কিন্তু এখনো সরকারপক্ষ পেপারবুক তৈরি করতে পারেনি। ফলে আটকে আছে ডেথ রেফান্স ও আপিল শুনানি।
বহুল আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা হয় গত বছরের ১০ অক্টোবর। মোট ৪৯ জন আসামির মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেয় আদালত।
এর মধ্যে বিএনপির সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ৩১ জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
তিনজনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্যরা পলাতক।
রায়ের অনুলিপি প্রকাশের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৭ আসামি ৩৪টি এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি ১৪টি আপিল দায়ের করেন।
জানা গেছে, ‘ডেথ রেফারেন্স’ শুনানির প্রস্তুতি হিসেবে হাইকোর্টে পেপারবুক (মামলার এজাহার, নিম্ন আদালতের রায়ের কপিসহ যাবতীয় নথি) প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছে। পেপারবুক প্রস্তুত হলেই ‘ডেথ রেফারেন্স’ শুনানির জন্য হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে পাঠাবেন প্রধান বিচারপতি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের দুটি মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ‘ডাবল’ মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।
একই অপরাধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে ‘ডাবল’ যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অন্য আসামিরা হলেন- হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম ও রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্য সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডাক্তার জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলুবুল, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, মো রফিকুল ইসলাম সবুজ, মোঃ উজ্জল ওরফে রতন, হরকাতুল জিহাদ নেতা আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মাদ ওরফে জিএম, শেখ আব্দুস সালাম, কাশ্মিরী নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাট ও মাওলানা শাওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ।
মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে মো. হানিফ ও মাওলানা তাউদ্দিন ছাড়া অপর ১৭ আসামি কারাগারে রয়েছেন।
যাবজ্জীবন পাওয়া অন্য আসামিরা হলেন বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ, বিএনপি দলয়ি সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) সদস্য শাহাদত উল্যাহ ওরফে জুয়েল, আরিফ হাসান সুমন, আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, বাবু ওরফে রাতুল বাবু, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ও লিটন ওরফে মাও. লিটন ওরফে দোলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্তদের মধ্যে কমিশনার আরিফ, জুয়েল, সুমন, সাব্বির, আব্দুর রউফ, সেলিম হাওলাদার এবং ইয়াহিয়া কারাগারে রয়েছেন। অপর ১২ আসামি পলাতক রয়েছেন।
রায়ে বলা হয়, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগীরা গ্রেনেড হামলার কিছুদিন আগে বনানীর হাওয়া ভবনে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে এক বৈঠকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করার সহযোগিতা চায় জঙ্গিরা।
তারেক রহমান উপস্থিত সবার সামনে জঙ্গিদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। আর ওই হামলার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তার দলকে নেতৃত্বশূন্য করা। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ করা হয়।
প্রকাশিত রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন। কিন্তু এত দিনেও আপিলের শুনানি শুরু হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এ মামলায় নিম্ন আদালত কয়েকজনকে ফাঁসি দিয়েছেন, কয়েকজনকে যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দিয়েছেন। যেহেতু এখানে মৃত্যুদণ্ডের সাজা আছে, এটা ডেথ রেফারেন্স হিসেবে শুনানি করতে হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের মামলায় প্রথমত রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক তৈরি করা হয়। এ পেপারবুক তৈরি হলেই আমরা শুনানির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।
পেপারবুক তৈরি হতে কত দিন লাগতে পারে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পেপারবুক তৈরি কত দিনে হবে সেটা হাইকোর্টের কর্মচারীরা বলতে পারবেন। আর পেপারবুক তৈরি হলে আদালতের ইচ্ছার উপরে নির্ভর করবে শুনানি কবে করা যাবে।
তবে পেপারবুক প্রস্তুত হলেই শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়। ওঠার পর দিন থেকে শুনানি করতে পারে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করলে দ্রুত করা যায়।
এ ব্যাপারে হাইকোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. সাইফুর রহমান জানান, পেপারবুক তৈরির কাজ চলছে।
তিনি বলেন, এ জন্য ডেথ রেফারেন্স শাখার দুজন মুদ্রাক্ষরিক মামলার সব নথি টাইপের কাজে সার্বক্ষণিক নিযুক্ত রয়েছেন। এটা সম্পন্ন হলেই পেপারবুক ছাপানোর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মো. সাইফুর রহমান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলার পেপারবুক অনেক সময় সুপ্রিমকোর্ট নিজেই ছাপিয়ে থাকে, না হলে বিজি প্রেসের মাধ্যমে ছাপানো হয়ে থাকে। তবে এ মামলার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
পলাতক আসামিরা
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তায় ছয়জনের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক মীর সোহেল রানা বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ছয়জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের সহায়তায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। বাকি ১০ জনের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারির প্রস্তুতি চলছে।
রেড জোনের ছয়জন হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হানিফ পরিবহনের মালিক হানিফ মোহাম্মদ, মোহাম্মদ তাজউদ্দিন মিয়া, চৌধুরী আবুল হারিস ওরফে হারিস চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদ, রাতুল আহমেদ বাবু।
পুলিশের পক্ষ থেকে আরও দশজনের ব্যাপারে রেড এলার্ট জারির বিষয়টি চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তবে লবিস্ট নিয়োগ করে রেড জোন থেকে নিজেদের নাম বাদ দিয়েছেন তারেক রহমান ও শাহ মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদ।
এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, আপিল শুনানি চলছে। শুনানি শেষ হলেই মামলার রায় কার্যকর করা হবে। বিদেশে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তিনি বলেন, পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।
২০০৪ সালের ২১ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয কার্র্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলার দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান, মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী সুফিয়া বেগম, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মমতাজ রীনা, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মাহবুব, দলীয় কর্মী রফিকুল ইসলামসহ ২৪ জন নিহত হন।
আহত হন দলের কেন্দ্রীয় নেতা আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ নাসিম, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাহারা খাতুনসহ প্রায় তিন শতাধিক।
সেদিন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকেল ৫টা ২২ মিনিট থেকে এক-দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি বিস্ফোরণ ঘটে। সভার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকের ওপর, এর পাশে, সমাবেশস্থলে এসব বিস্ফোরণ ঘটে। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও বিস্ফোরণের শব্দে তার কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়।