এক ঝাঁক মানুষের মুখ

মনি হায়দার

বাজান?

এক ডাকে সাড়া পায় না আলতাবানু। বিড়ি টানছে মমিন মোল্লা। কাঁধে গামছা। অনেকগুলো ফুটো গামছাটায়। মাটি কাদায় একাকার। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অধিকাংশ পাকা। পরনের লুঙ্গিটা হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো। বসে আছে হাঁটু উঁচু করে। অন্যান্যদের সঙ্গে সে অপেক্ষা করছিল।

universel cardiac hospital

বাজান? ও বাজান?

সাত বছরের মেয়ে আলতাবানু বাপের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। মমিন মোল্লা ঘাড় ফিরিয়ে দ্যাখে আলতাবানুকে। চোখে মুখে কোনো পরিবর্ত ঘটে না। বিড়ির শেষ অংশ ডান হাতের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে রেখে বলে-

কী?

মায় তোমারে বাসায় যাইতে কইচে।

ক্যা? কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করে মেয়েকে। বিড়ি টানা শেষ। এখন টান দিলে আঙ্গুল পুড়বে। বিড়িটা সে ফেলে দেয়। নতুন ছোট ছোট মাটির ঢেলার মধ্যে তখনো বিড়িটার অবশিষ্টাংশ জ্বলছে। ছোট্ট একটা ধোঁয়ার রেখা উঠছে। বিড়িটা তাড়াতাড়ি নিভতে চায় না। মমিন মোল্লার মতো ধুঁকে ধুঁকে আরো অনেক সময় বেঁচে থাকতে চায়।

ঘরে চাউল নাই। মরিচ লাগবে। নুনও নাই।

ও।

মমিন মোল্লা এক দলা থুথু ফেলে। কেন এই থুথু? নিজের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করছে? নাকি বিড়ি টানার জন্য মুখ তিতো হয়েছে? সে কিছুই বঝুতে পারে না। সকাল থেকে এখন প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা কাজ করে ক্লান্ত মমিন। মাটির ওপর শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ইচ্ছেটা আরো গতি পায় আলতাবানুর চাউল নাই, নুন নাই-ইত্যাকার অজস্র নাই শব্দটির বিষাদ উচ্চারণের কারণে। তার ঘরে যে কিছুই নেই মমিন মোল্লা ভালো করেই জানে। সে জানবে না তো কে জানবে? ঘর-সংসার সবই তার। জীবন-জীবনের তিক্ততা, ক্ষুধা, বিড়ির অবশিষ্টাংশ টানা এবং রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে আলতাবানুর মায়ের কংকালসার দেহটা’দুই বাহুর মাখখানে আবিষ্কার করা-সবই তার করণীয় বিষয়।

মমিন মোল্লা মাঝে মাঝে অবাক হয়। না হয়ে পারে না সে। আলতাবানুর মায়ের সঙ্গে  তার মানসিক, সাংসারিক ও শারীরিক যোগাযোগ প্রায় দেড় যুগের। দেড় যুগ আঠারো বছর। কম সময় নয়। এর মধ্যে অর্থাৎ আঠারো বছরের ব্যবধানে হানুফা বেগমের গর্ভে এসেছে সাত-সাতটি জীবন। তারা কেউ হোটেলের মেসিয়ার, কেউ রাস্তার ঝাঁড়ুদার। বড়ো মেয়েটি মালকাবানু পাড়ার একটা মুচি ছেলের সঙ্গে বিয়ে বসেছে। তিন চারটে এখনো ছোট। তারা দিনে রাতে হানুফা বেগম-যার সঙ্গে মমিন মোল্লার এত ঘনিষ্ঠ নিবিড় ধর্মীয় সম্পর্ক, সে কিনা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বাসিমুখে, রাগিস্বরে বলে-ঘরে কইলো চাউল নাই।

ঘরে চাউল নাই-এই কথাগুলো শেনার সঙ্গে সঙ্গে হানুফা বেগমের সঙ্গে তার রাতের সম্পর্ককে মনে হয় সাপের সঙ্গ সহবাস। এত বড়ো দীর্ঘ জীবনে হানুফা বেগম কি কখনো বলেছে-আইচ ঘরে চাউল আছে!

সে মনে করতে পারে না। সম্ভবত বলে নি। তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, সংসার জীবনে সে কখনো একবেলার বেশি দুই বেলার খাবার যোগাড় করতে পারে নি। কেন পারে নি? সেতো কাজ করেছে প্রতিদিন। জ্বরে, বৃষ্টিতে, খরায়-অসুখে, ক্ষুধায় মমিন মোল্লা আঠারো বছরের একটা দিনও পরিশ্রম না করে থাকে নি। ঘাম ছুটিয়ে সে কাজ করেছেন। মমিন মোল্লা হারিয়ে যায় জীবনের অন্য এক প্রান্তে। যেখানে ছোট্ট একটা নদী ছিলো। ছায়াঢাকা গ্রাম। সারাদিন মমিন করাত টানে। বড়ো বড়ো গাছ কাটে। আকাশছোঁয়া বিরাট গাছগুলো করাতের হালকা টানে সে মাটিতে শুইয়ে দিতো ধপাস শব্দে। তারপর শুরু হতো মাপা। মাপজোপ শেষে কেটে কেটে টুকরো করা। মাচা বানিয়ে টুকরোগুলো উঠাতো তাতে।

আবার করাত টানা। একজন নিচে, অন্যজন উপরে। একনাগাড়ে করাত টেনে কত্তা, আঁড়া, খুঁটি, কাপট বানাতো। গাছ কাটার ব্যাপারে এলাকার বড়ো কারিকর সে। দূরের গ্রাম থেকে লোক আসে মমিন মোল্লার কাছে। বায়নার টাকা নেয়। পান-তামাক খাওয়া দাওয়া চলে। এভাবেই চলে আসছিলো দীর্ঘদিন থেকে।

বাধা হয়ে দাঁড়ালো রহিম মোল্লার করাত কল। গ্রামের পাশে কারেন্ট এসেছে। সেখানে প্রতিবেশী জোতদার রহিম মোল্লা করাতকল বসায়। সবাই এখন নৌকায় করে গাছ নিয়ে যায় রহিম মোল্লার ‘মোল্লা স মিল’-এ দ্রুত, কম টাকায় মাপ অনুযায়ী গাছ কেটে বাড়ি যায়-মমিন মোল্লার বাড়ির সামনে থেকে।

সে বিড়ি টানে আর দ্যাখে। এখন তার প্রচুর সময়। গাছ কাটার জন্য কেউ ডাকে না। দিন চলে যায় উপোসে। কী করবে সে? অনেক ভেবে চিন্তে মমিন মোল্লা তার দীর্ঘদিনের আয়-রোজগারের একমাত্র অবলম্বন করাতটা বিক্রি করে দেয়। কেনে গরু। সে নতুনভাবে জীবনের শুরু করতে চায়। হালচাষ করে সে কৃষক হবার   চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কুল পায় না। সারা জীবনের পেশা ছেড়ে মমিন মোল্লা অর্থে সমুদ্রে পড়ে। তার নিজের জমি তেমন নেই। ভেবেছিলো আশপাশের পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে বর্গা চাষ করতে জমি দেবে। বলেওছিলো অনেকে।

ও পাড়ার হাতেম খা, সৈয়দ আলী বলেছিলো-চাষাবাদ হরবেন-ভালো। মোরা আপনারে জমি দিমু।

দেবেন তো?

কন কী? দিমু না ক্যা? আমাগো জমিতো মাইনষেই নেয়। আপনে আপন মানু। দিমু-আপনেরে দিমু।

আইচ্ছা।

মমিন মোল্লা খুবই খুশি। অথচ এখন কেউ জমি দিতে চায় না। তাদের ধারণা-মমিন মোল্লা নতুন মানুষ। তার দ্বারা জমি ভালো চাষ হবে না। ধানও ভালো ফলবে না।

চাষাবাদের অনেক কিছুই তার অজানা, ঘটনাটিও তাই।

কোমড় পানিতে গরু নিয়ে হালচাষ করতে গিয়ে পানি জোঁকের তীব্র রক্তচোসা, পায়ে প্যাক ধরা, জমিচাষে কম পাওয়া, ঘরে খাবার না আনা-সবকিছু মিলিয়ে বিপ্রতীপ জীবনের খানা-খন্দক চড়াই উৎরাই দতাকে মুমূর্ষু করে তোলে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের রোদ বৃষ্টি কাদা সহ্য করে ধান বোনার পর দেখলো-সব ধান পামরি পোকায় খেয়ে ধ্বংস করেছে। কেবল ধানের খোসা বাতাসে এলোমেলো নাচে। এ বিঘা জমিতে মাত্র তিন চার কাঠি ধান। অথচ সে আশা করেছিলো, কমপক্ষে ষোল কাঠি ধান হবে প্রতি বিঘায়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে চাষাবাদের সময় রাজামিয়া মহাজনের কাছ থেকে দাদন এনেছিলো। প্রতি এক শ’ টাকার এক কাঠি ধান। দেড় বিঘা জমিতে মোট ধান হয়েছে সাত কাঠি। সে মহাজনকে কী দেবে? নিজে কী খাবে? হানুফা বেগমের কাপড় নেই। ছিঁড়ে ছিঁড়ে ত্যানা। সেলাইয়ের পর সেলাইতে মোটা দড়ি হয়েছে কাপড়। বিপর্যস্ত মমিন মোল্লা সর্বহারা মানুষের মিছিলে যোগ দেয়। দাদন শোধ করতে না পারায় রাজামিয়া মহাজন মাঠ থেকে তার গরু দুটো নিয়ে গ্যাছে।

পেট ক্ষুধায় কড়াই। খাবার না পেলে সে কড়াই তেতে ওঠে। পেট জ্বলে। দাউ দাউ করে সর্বগ্রাসী আগুন তাকে এবং তার সংসারকে ঝাপটে ধরে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির পূর্ব কোণায় দাঁড়ানো চার পুরুষের স্মৃতিবাহী থুরথুরে বুড়ো নারকেল গাছটা বিক্রি করে, কচা নদীর পারের, একদা মোল্লা বংশের ছেলে, পরবর্তীতে হানুফা বেগমের স্বামী করাতি মমিন মোল্লা যার সাত সাতটি সন্তান সে এবং তার সংসার শহরে আসে।

কাজ মেলে না এখানেও। এইসব মানুষেরা সারা জীবন বঞ্চিত জীবনের সমস্ত অধিকার থেকে। এ শহর কাঠের নয়, ইটের। করাত এখানে আত্মার রক্ত চোষা এক অশরীর-চাকুর নাম। কাটে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়।

বাজান? ও বাজান?

আলতাবানু ডাকে। সাড়া দেয় না মমিন মোল্লা যেহেতু সে এখানে নেই। অনেক দূরে চলে গিয়েছিলো। ফিরে আসতে সময় লাগে। ফিরে আসতে আসতে সে তাকায মেয়ের দিকে। আলতাবানু বুঝতে পারে না-বাবা কেন চুপচাপ? কেন চাল, ডাল, তেল, নুন, মরিচ কিনে দেয় না? খুব রাগ হয় বাবার ওপর। পেটে খুউব  খিদে। বাজার করে দিলে ঘরে নেবে। মা রান্না করবে। তারপর সবাই মিলে খাবে। অথচ বাবা তখনো কেমন একরোখা আর নির্বিকার।

বাজান? ও বাজান?

কী?

কইলাম না তোমারে-মায় বইয়া রইছে। ঘরে চাউল নাই। চাউল কিইন্না দিবা না?

দিমু তো।

য় দেও না ক্যা? দেও।

একটু ব। দিমু আনে।

ক্যা? আলতাবানুর কণ্ঠে রাগ; ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা এবং কান্না। এই কান্না ক্ষুধার যে যন্ত্রণা-তার প্রতিক্রিয়ার।

কদ্দুসরে পাডাইচি কন্ডাকটরের বাসায়। এহনো টাহা পাই নাই। পাইলেন চাউল কিইন্না বাসায় যামুনে। তুই ব। মমিন হাত ধরে মেয়েকে কাছে টানে।

দুই পায়ের ওপর স্থির দাঁড়িয়ে থাকে আলতাবানু। সে জানে কাজের পর প্রতিদিন কন্টাকটর এসে সবাইকে টাকা দেয়। মাঝে মাঝে কন্টাকটার আসে দেরি করে। বাবার টাকা পেতেও দেরি হয়। বাজার করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে, রাত। ততক্ষণে ছোটভাই বোনগুলো না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

আলতাবানুর একটু একটু শীত করে। অন্ধকার জাঁকিয়ে আসছে। গায়ে পেঁচানো কাপড় আরো টেনে নেয় শরীরের সঙ্গে।

ও মমিন ভাই?

কী কও? সালামের ডাকে সাড়া দেয় মমিন মোল্লা।

বিড়িটা কই? দেও না একটা টান দি-

হালাইয়া দিচি।

ও।

হালার কোন কাম করতে আইলাম-আমজাদের কণ্ঠে তীক্ষ্ম ক্ষোভ। কাম শেষ অইয়া গেলেও টাহা পাই না। হারাদিন খাইলাম না কিছু। খিদায় পেডের মধ্যে কুত্তা বোলে।

সালামকে সমর্থন করে গৌরাঙ্গ কর্মকার-এইডা ঠিকই কইচো আমজাদ ভাইডি। মোরও খিদা লাগচে খুউব। এই কাম না কইর‌্যা ভোডের ক্যানভাসে গেলে ভালো অইতো। ।

যাবি নাহি কাইল? দলের একজন জানতে চায়।

তুমি গেলে মুইও যামু হারাদিন মাডি কাডা আর ভালো লাগে না। গৌরাঙ্গ মতামত জানায়।

বিশ থেকে পঁচিশ জন মানুষের জটলা এখানে। সকাল থেকে মাটি কেটে রাস্তা তৈরি করে। জায়গাটার নাম রায়ের বাজার। মমিন মোল্লা শুনেছে সামনের খানা খন্দকের ভেতর একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী বধ্যভূমি বানিয়েছিলো। এই দেশের রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সহায়তায় পাকিস্তানি কুত্তা বাহিনী হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলে রেখেছিলো। এরই আশে পাশে দিয়ে বিশাল বেড়িবাধ নির্মাণ করা হচ্ছে। রাস্তার মাটি কাটতে যেয়ে বেশ কয়েকটা মাথার খুলি ওরা পেয়েছিলো।

মমিনের খোন্তার কোপ হঠাৎ তিন আঙ্গুল দেবে আর ভিতরে যায় না।

কী অইচে? জিজ্ঞেস করে আমজাদ।

খোন্তা যায় না ক্যা?

কেমনে কমু? জবাব দেয় মমিন। পাশের দেলোয়ার হেসে বলে-দেহো সোনার কলস পাইচো নাহি?

ওর কথাই সবাই হাসে।

কইচো বড়ো একটা কতা-বেদনা মিশ্রিত স্বরে জবাব দেয় মমিন মোল্লা। জীবনে হোনচো কোনোদিন ফাটা কপালে মানিক জ্বলে? নিজেই উত্তর দেয়-জ্বলে না জ্বলে না।

ধীরে ধীরে মাটি সরায়। দেখতে পায় মানুষের মাথার খুলি। বুকটা তার কেঁটে ওঠে-আহা। কার মায়ের পুত! এভাবেই অনেকেরই খোন্তার মাথায় অনেকগুলো মাথার খুলি পায়। সবগুলো জমা করে একটা বড়ো র্গত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়। বাবার কথা মনে পড়লে মমিন মোল্লার বুক প্রবল ঝাঁকুনি খায়। মনে হয় উথাল পাতাল ঢেউ ওঠে রক্তের সাথে। মমিন মোল্লা বাবা কেরামত মোল্লা রাজাকারদের হাতে মারা গেছে। লাশটা পর্যন্ত পায় নাই। ভাইসা গেছে নোনা দরিয়ায়। কেরামত মোল্লা আর কয়েকজন পাড়া প্রতিবেশী মিলে গিয়েছিলো মাইল পাঁচেক দূরের পাড়রহাটে বাজার করতে।

কচা নদী। বিকেলের ভাটির টান। বাজার শেষে আবার সবাই নৌকায়, উঠে গ্রামের দিকে ফিরছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে নৌকা খালের ভিতর ঢুকতেই পাড়ে দাঁড়ানো রাজাকারেরা ডাকে-এই নৌকা ভিড়াও।

মাছি নৌকা ভিড়িয়ে দেয়। রাজাকারদের সঙ্গে চারজন পাকিস্তানি সৈন্য। তাদের নেতা সবাইকে কূলে উঠতে বললে সবাই কূলে ওঠে। কলমা পড়তে বললে-সবাই কলেমা পড়ে শোনায়। তাতেও ওরা সন্তুষ্ট হতে পারে না। সবাইকে কাপড় খুলে দাঁড়াতে বলে। কেউ রাজি হয় না। হঠাৎ নেতা গুলির আদেশ করে-ফায়ার। কোনো কিছু বোঝার আগেই মমিন মোল্লার বাবা কেরামত মোল্লা, নওবান আলী, সুরত আলী খাঁসহ সবাই মুখ থুবড়ে পড়ে বুকে ফেটে কোমরে মাথায় ঝাঁক ঝাঁক তপ্ত সিসার ধাক্কা খেয়ে, সবুজ ঘাস হলো রক্তলাল। জীবন হলো পাখি। ধর্ম হলো খনন কূপ। মাটি করলো নিখাদ রক্ত পান।

কচা নদীর পাড়ের কেরামত মোল্লার ছেলে সেই মমিন মোল্লা এখন বাপের বাস্তভিটা ছেড়ে কোথায় কতদূরে ইট কাঠ-সুড়কির বিস্তীর্ণ পলেস্তারের নিচে লোমওঠা কুকুরের জীবন যাপন করছে। পরের জমির মাটি কাটছে। রাস্তা বানাচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে কত মহাজন যাবে। আর সে? সে বলদের মতো অন্য কোথাও মাটি কাটবে কিংবা মাথায় করে টানবে।

মাটি! মমিনের বুকের পাঁজর থেকে মাঝে মাঝে মাটি ডাক দেয়। রক্তজীব যে মাটিতে প্রথম বোনা হয়েছিলো-সে মাটি তাকে বারবার ডাকে। শুনতে পায় সে। কী উথাল-পাথাল ডাক! সে যেতে পারে না। মাটির ওপর খড়ের চালের ঘর বানিয়ে থাকা যায়, কিন্তু রাক্ষুসী ক্ষুধার সময় মাটি খাওয়া যায় না।

বাজান? ও বাজান?

কী? মেয়ের ডাকে মমিন মোল্লা ফিরে তাকায়।

যাইবানা?

যামুতো।

তয় শিগগির লও। মায় বইয়া রইচে। মোর খিদা লাগছে।

মেয়েটার মাথার হাত বুলায়-আর একটু ব মা। আর একটু ব। গেলেতো অইবে না-টাহা লইয়া যাইতে অইবে। নাইলে ঘরে যাইয়া খামু কী?

বাপের কথায় আপাতত আলতাবানু চুপচাপ তার ফ্রকের এক কোণা মুখে দিয়ে চিবুতে থাকে।

মমিন ডাকে-বারেক? ও বারেক?

কী  কন চাচা? ছোকড়া বয়সাী একটা ছেলে উঠে দাঁড়ায়। গা খালি। মাথায় কেবল একটা গামছা পেঁচানো।

খবর টবর কী? কারে পাডাইচো কন্টাকটারের বাড়ি?

পাডাইচি চাচা সুলতানরে।

এহনো আয় না ক্যা? আর কত বইয়া থাকমু। পিডের ধারা এক্কেরে ব্যাতা অইয়া গ্যাচে। মাইয়াডা খিদায় কানতাচে।

আল্লায় জানে হালারপুত কন্টাকটরে বাড়ি আচে না কোতায় গ্যাচে গা-মাঝখানে মাছের মতো ঘাউ মেরে উঠলো রশিদ।

বারেক চেঁচিয়ে ওঠে-বাড়ি না থাকলে হুমুন্দির পুতের ঘরে আগুন লাগাইয়া দিমু। পাইচে কি আমাগো? আমরা কি হের কেনা গোলাম?

আর ঘরে আগুন দিলে কী আইবে? পিছু টানের কথা শোনায় মমিন-আমাগো পেডের খিদা কি মরবে? কাম করি টাহার জন্য, টাহা পাইলেই অইবে। অতো আগুন দেয়ার কাম নাই।

তোমাগো লাইগ্যা কিচু পারমু না। ফোঁস করে ওঠে বারেক-নাইলে হেইদিনই হালার মাতাডা খোন্তার এক কোপে দুই বাগ কইর‌্যা হালাইতাম।

দিন পাঁচেক আগে কণ্টাকটর ভর সন্ধ্যায় এসে বলে-আজ টাকা দিতে পারবো না।

ক্ষুধার্থ মানুষগুলোর অসহায় মুখগুলো ক্রোধে চিৎকার করে ওঠে-ক্যা? ক্যান দিতে পারবা না?

অসুবিধা আছে। কন্টাকটর জবাব দেয়।

কী অসুবিধা?

সিগারেট টানতে টানতে জবাব দেয়-দুনিয়ার কোনো খবর রাখে না দেখছি। জানোনা আজকে সারাদিন হরতাল ছিলো। ব্যাংক বন্ধ। টাকা তুলতে পার নি।

হরতাল অইচে কী অইচে? সামনে বুকটান করে দাঁড়ায় বারেক। আমরা কোনো হরতাল করি নাই। হারাদিন বলদের মতো মাটি টানচি। খিদা লাগচে- টাহা দেন। বাসায় যামু। সবাই চাইয়া রইচে। শিগগির টাহা দেন।

বললেই টাকা পাওয়া যায় নাকি?

হেই সকালে ক্যান কইলেন না-ক্যান কইলেন না? হারাদিন কাম কইরা রাইতে বাসায় খালি আতে যাইতে পারমু না। ব্যবস্থা করেন শিগগির।

কোনো ব্যবস্থা করা যাবে না-স্পষ্ট  বলে কন্টাকটর।

কয় কি হালায়? আমরা বুঝি মানু না? ধর হালারে-বারেক মাটি কাটা খোন্তা নিয়ে দৌড়ে আসে কন্টাকটরের দিকে। সারাদিনের পরিশ্রমে মেজাজ তেতে ছিলো। তার ওপর কন্টাকটরের চটাং চটাং অমন কথা বললে ধৈর্য রাখা সত্যিই কঠিন। সবাই বারেককে আটকে ধরে-বারেক, ও বারেক তুই কর কী? থাম। মাথা ঠাণ্ডা কর।

মহা শোরগোল। কন্টাকটর দৌড়ে কয়েকজন মানুষের মধ্যে দাঁড়ায়। ভয়ে কাঁপছে। নানা কথাবার্তা। কেউ কন্টাকটরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে গালি দেয়। কেউ বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত কন্টাকটর মাফ চেয়ে চলে যায়-কালকে টাকা অবশ্যই দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সর্দার মোবারক-অই হুমন্দির পুতেরা, অতো বেশি গজর গজর করিস না। এতক্ষণ সে কোনো কথা বলে নি। কেবল চুপচাপ শুনেছে। প্রত্যেক কামলার পাওয়া প্রতি টাকা থেকে তার বখরা দশ পয়সা। অবশ্যই হিসেবে করে দিতে হয়। অনেকে দিতে চায় না। কিন্তু না দিলে কাজ পাওয়া যাবে না। পয়সা দেয়ার কথা মনে পড়লেই মনটা খারাপ হয় মমিনের।

আরে হালার কাম করুম আমি মাথায় ঘাম হালাইয়া, শরীরডারে কষ্ট দিয়া হারাদিন যে কয়ডা টাহা কামাই করুম তুমি হালার কোন জমিদারের পোলা যে তোমারে ভাগ দেওয়া লাগবে?

উপায় নাই। উপায় নাই। উপায় নাই।

মমিন মোবারক আলীর কথায় তার চোখের দিকে তাকায় -কী?

কাইল থেইকা তোরা যেদিকে পারো কাম খুইজ্যা নিস। কন্টাকটর হালায় মানুষের বাচ্চা না। নেমকহারাম। হারামজাদা কয়দিন ধইর‌্যা দেখতাছি খালি ঘুরায়।

সর্দার মোবারক আলীর কথায় সবার মুখ শুকিয়ে যায়। তবুও একটা কাজ পেয়েছে। কাজ করলে আজ না হয় কাল অন্তত দু’দিন পর হলেও টাকাটা পাওয়া যাবে। একদম কাজ না থাকলে ছেলেমেয়ে নিয়ে উপোস করে মরণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। মমিন মোল্লার আত্মা শুকিয়ে কাঠ।

হঠাৎ দূরে একটা কোলাহল শোনে। কী ব্যাপার? মাথা উঁচু করে, কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে। বারেক সবার মধ্যে থেকে বলে ওঠে-ওডা বোডের মিছিল। মুই কাইল মাডি কাটতে আমু না। মিছিলে যামু।

তোমার লগে মুইও যামু। কথাটা আগ বাড়িয়ে বলে গৌরাঙ্গ।

আচ্ছা।

অন্যেরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মিছিল না মাটি কাটা? মাটি কাটা না মিছিল? কোনদিকে গেলে পেটের আহার ঠিকমতো যোগাড় হবে? মিছিলটা খুব কাছে এসে পড়ে-আমার ভাই- তোমার ভাই, খলিল ভাই-খলিল ভাই। ভোট দিন-ভোট দিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন।

মমিন মোল্লার ঘোর লাগে। শহরে এতসব ঘটনা ঘটে গ্রামে থেকে কিছুই বোঝা যেতো না। কেবল অন্ধকার নিরবিচ্ছিন্ন, জমাটবাঁধা অন্ধকার। গত কয়েক বছরে সে শহরে থাকায় দেখতে পেয়েছে আন্দোলন, মিছিল, টিয়ারগ্যাস, হরতাল, গুলি, মৃতদেহ আর চাপ চাপ রক্ত। এত কিছুর পরও-কই তার জীবনের কোনো পরিবর্তন তো এলো না। একটা মিছিল সে একবার দেখেছিলো-বছরখানেক আগে পল্টনের চৌরাস্তার মোড়ে। বিরাট মিছিল সাপের মতো লম্বা আর গুছানো ছিলো সে মিছিল। সামনে মেয়েরা কী অবলীলায় পা ফেলে হেঁটে যায়। পিছনে ছেলেরা। সবার মাথায় বাঁধা লাল এক টুকরা কাপড়। মমিন মোল্লার বড়ো ভালো লেগেছিলো সেই মিছিলটি। এখনো চোখ বুজলে সে দেখতে পায়, পায়ে-পায়ে সারিবদ্ধভাবে মিছিলটি পিঁপড়ার মতো এগিয়ে যাচ্ছে। তার সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো একটি শ্লোগান-এ সমাজ ভাঙতে হবে-নতুন সমাজ গড়তে হবে।

এ রকম একটা কথা-উইপোকার বাসা বেঁধে ছিলো তার মনে। কেবল ঘুর ঘুর করতো কথাগুলো। কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিলো না। মাঝে মধ্যে তার মনে হতো অপ্রকাশিত কথাগুলো মাথার করোটির ভেতর তীব্র যন্ত্রণার তড়পাচ্ছে। মাথার চাঁদি ফেটে এক সময় হয়তো বেরিয়ে পড়ে কংক্রিটের রাস্তায় হাঁটবে কথাগুলো। অথচ কী আশ্চর্য সেই অনবদ্য অবিসংবাদিত  কথাগুলো পাখির রঙিন পালকের মতো টিয়ারগ্যাসের ঝাঁঝালো গন্ধের তীব্রতায়, বন্ধুকের গুলির মতো রাস্তায় গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ছে। সে শারীরিকভাবে ঐ মিছিলে মিশতে পারে না, কিন্তু স্লোগানের সঙ্গে মিশে গেছে। গুলিস্তানের যে মিছিলে দু’জন ছাত্রকে ট্রাকের তলে চাপা দিয়ে মেরেছিলো-প্রায় তারই চোখের সামনে। সে বিকেল বেলা ফিরছিলো কাজ শেষে-তখনই ঘটনাটা ঘটে। ভীষণ কষ্ট হয়েছিলো তার। কয়েক রাতে সে ঘুমাতে পারে নি। থেতলানো রক্তাক্ত দেহ চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। তার মনে হতে থাকে লাশ দুটো বারবার তাকে ডাকছে।

এমন কোনো দিন ছিলো না-সেদিন শহরে মিছিল মিটিং হয় নি। জনসভার পাশে দাঁড়িয়ে একজন বক্তার বক্তব্য শুনেছিলো-সামরিক সরকার দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। গরিব মানুষের রক্তঋণ দিয়ে অস্ত্র কিনে গুদামজাত করছে। যা সময় এবং সুযোগ বুঝে বাংলার গরিব মেহনতী মানুষের বুকে মারবে। এদিকে জিনিসপত্রের দাম আগুনের মতো বাড়ছে। চালের সের পনেরো টাকা। কাঁচা মরিচ আশি টাকা সের। নুন পনের টাকা সের দরে কিনতে হচ্ছে। এভাবে দাম বাড়লে গরিব মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। মমিন মোল্লা সমিরক শাসন, অস্ত্র এসব না বুঝতে পারলেও চাল, নুন, কাঁচা মরিচের দামের কথাটা বুঝেছিলো। বক্তা অনেক দূরে। চোখে ভালো দেখতে পায় না সে। তারপরও বক্তার কথাগুলো; তার ভীষণ ভালো লেগেছিলো!

মমিন মোল্লা আবার দেখলো আন্দোলনের তীব্রতায় সামরিক সরকার ক্ষমতা ছাড়লো। বিজয় মিছিল বের হলো। ভোট আসছে। অলিগলি ছেয়ে গেছে পোষ্টারে পোষ্টারে। কিন্তু ভরসা পাচ্ছে না মমিন মোল্লা। বারবার সে তার হাত জোড়া সামনে ওঠায়। দু’চোখ মেলে-দ্যাখে! যদি তার একখান করাতকল থাকতো!

বুকচিরে দীর্ণ দীর্ঘশ্বাস বের হয়। আলতাবানু শীতে কাঁপে। উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাস লক লকে জিহ্বা নিয়ে ধেয়ে আসতে থাকে। সেই সঙ্গে গাঢ় ঘন অন্ধকার আরও গাঢ় ঘন হয়ে নামছে। সবাই অধৈর্য হয়ে পড়েছে। সূর্য ডুবছে। এ সময়ে সুলতানকে হন হনিয়ে আসতে দেখে সবাই আশান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।

ঐতো সুতান আইচে-ভীড়ের মধ্যে কে একজন চেঁচিয়ে ওঠে।

সামনে এগিয়ে যায় অনেকে। শীর্ণ মানুষগুলো গা ঝাড়া দেয়। এখনই টাকা পাবে। বাজার করবে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, পিঁয়াজ, মরিচ নিয়ে ঘরে ফিরবে। সারা দিনের উপোসী চুলোয় আগুন জ্বলবে।

এত দেরি অইচে ক্যা? জিজ্ঞেস করে গৌরাঙ্গ।

অইবে না? জবাব দেয় সুলতান- কন্টাকটারকে তো পাই নাই।

পাও নাই? শব্দ দুটো এক ঝাঁক বুভুক্ষু মানুষের হৃদপিণ্ড চিড়ে আর্তনাদে ফেটে পড়ে।

না।

ক্যান? ক্যান পাও নাই? সম্মিলিত জিজ্ঞাসা।

কন্টাকটর বাসায় আছিলো না-বলে সুলতান। অপেক্ষা করার পর আইচে।

হেরপর?

আমারে কইলো ব্যাংক থিকা টাহা উঠাইতে পারে নাই। হের হালির নাহি বিয়া। ব্যস্ত আচিলো। কাইল দেবে।

মমিন দেখলো তার হাত ধরা ছোট মেয়েটির মুখ আরো কুঁকড়ে গেছে। দুটি চোখে ক্ষুধার আগুন জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। আর তারায় তারায় আলোকিত সন্ধ্যার আকাশটা, শহরের উত্তরপাড়া থেকে জলপাই রঙের ট্যাংকের ডানায় এবং চাকায় ভর দিয়ে নিকষকালো যুথবদ্ধ অন্ধকারে হালুম শব্দে ঢেকেগেলো দানবিক সামরিক শাসনের অসহ্য বুলেটিনের মতো।

লেখক পরিচিত:

মনি হায়দার: জন্ম ১৯৬৮ সালের ১ মে, বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার বোথলা গ্রামে। শৈশব থেকে লেখালেখি শুরু। লিখছেন গল্প, উপন্যাস।

তার প্রকাশিত বই ৫০-এর অধিক। ইতোমধ্যে তিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা। বর্তমানে উপস্থাপনা করছেন জি-টিভির শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান শিল্পবাড়ি । কর্মরত আছেন বাংলা একাডেমিতে।

অলংকরণ: মলয় হালদার, সঞ্জয় দে, মীর রবি

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে